Saturday, May 30, 2015

ব্যাংকিং বিবর্তনে আপদের আবর্তন!

অনলাইন ব্যাংকিং শৈশব পার করে যৌবনে পদার্পণ করেছে। প্রাথমিক বিস্ময় থেকে পরিকল্পিত বিকাশ আরম্ভ হয়েছে, ব্যাংকগুলি ক্রমান্বয়ে “পেপারলেস” ব্যাংকিং এর দিকে ধাবিত হচ্ছে। একই সাথে ব্যাংক গুলো সম্ভবত সূচনা লগ্ন থেকে আজতক এত বড় ও ব্যাপক চ্যালেঞ্জের সামনাসামনি আর কখনো হয়নি। একদিকে প্রযুক্তি গত বিস্ফোরণ, অন্য দিকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা যার সূত্রপাত ব্যাংকের হাত ধরেই। সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের হাত ধরে নতুন আরেক অদৃশ্য কিন্তু মহা পরাক্রমশালী যন্ত্রণার নাম “মানি লন্ডারিং”, যার পার্শ্ব প্রতিক্রয়া হিসাবে গ্রাহকের প্রতি নিয়ম কানুনের ও ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের প্রতি প্রশিক্ষন ও জরিমানার বোঝা বাড়ছে, ব্যাংক-গ্রাহক পারস্পারিক আস্থা কমেছে। আবার পরিবর্তনশীল আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে গ্রাহকের প্রয়োজন ও চাহিদাও সদা পরিবর্তনশীল। ফলে ব্যাংকের প্রথাগত ভূমিকা ও অবয়বের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী সময়ের প্রয়োজনেই। অস্তিত্বের প্রয়োজনেই ব্যাংককে পরিবর্তনের সুবিধা নিতে হবে। এই পরিবর্তনের ধারায় ব্যাংকগুলিকে সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হচ্ছে তা হল জালিয়াতি প্রতিরোধ। বিশেষ করে অনলাইন ব্যাংকিং এর বিকাশের সবচেয়ে বড় অন্তরায় হচ্ছে পরিচয় জালিয়াতি বা “আইডেনটিটি ফ্রড”। বর্তমানে সব ব্যাংকই তাদের নিজস্ব সুরক্ষা ব্যাবস্থার মাধ্যমে জালিয়াতি প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। কিন্তু যত বেশী সুরক্ষা ব্যাবস্থা তত বেশী গ্রাহক ভোগান্তি ও গ্রাহক বাড়তি সেবার প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি। তাই সব সময়ই ব্যাংক গুলিকে গ্রাহক তুষ্টি ও নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে সমন্বয় করতে হয়। আর জালিয়াতি জনিত ক্ষতি সমন্বয়ের ফলে আখেরে যেমন ব্যাংকের সেবা প্রদানের ব্যায় বাড়ে তেমনি জালিয়াতির বিররুদ্ধে প্রতিরোধ প্রোগ্রামও ব্যাংকের সামগ্রিক খরচ বৃদ্ধি করে। সব দেশ বা সব ব্যাংক বা সব গ্রাহকই সমান ঝুঁকিতে নাই তবে কেউই ঝুঁকির বাইরেও নয়। বাংলাদেশে এখনও তেমন উল্লেখ যোগ্য অনলাইন ব্যাংকিং জালিয়াতি হয়নি। তার মানে এই নয় যে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা খুবই শক্তিশালী, এর কারণ এখনও কোন বড় আক্রমনের ঘটনা ঘটেনি, যে কোন সময় তা হতে পারে। এখনো জালিয়াতদের নজর বাংলাদেশের উপর খুব একটা পড়েনি। সংঘবদ্ধ জালিয়াতদের কাছে এখনো বাংলাদেশের চেয়ে লোভনীয় অনেক সুযোগ আছে। তবে বন্ধু-বান্ধব-আত্নীয়-পরিজন-সহকর্মী বা দুর্জন প্রযুক্তি বিদ্বানের খপ্পরে পড়ার সম্ভাবনা সবসময়ই আছে। আর সহজ শিকার হিসাবে বাংলাদেশের প্রতি জালিয়াত চিলদের কুনজর পড়তেই বা কতক্ষন! অনলাইন ব্যাংকিং যেমন বৈশ্বিক তেমনি এর ঝুঁকিও বৈশ্বিক।
অনলাইন ব্যাংকিং এর শুরু থেকেই জালিয়াতি শুরু হয়নি, ২০০০ সালের শুরু থেকে এই সমস্যা এত প্রকোপ হয় যে ব্যাংক গুলোকে তা নতুন করে তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে। বেশীরভাগ অনলাইন জালিয়াতি দুই ধাপে বিভক্ত। প্রথমত গ্রাহকের হিসাবে প্রবেশের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য যেমন, আইডি, পাসওয়ার্ড ইত্যাদি সংগ্রহ। দ্বিতীয়ত সংগৃহীত তথ্য ব্যাবহার করে জালিয়াতির মাধ্যমে অন্যের হিসাবের অর্থ উত্তোলন বা স্থানান্তর। এদের প্রতিরোধ করা যায় প্রথমত তথ্য চুরি পর্যায়ে, পরবর্তীতে অবৈধ ভাবে লেন-দেন করার সময়ে। তবে প্রথম পর্যায়ে তা প্রতিরোধ করা অনেক সহজ ও সাশ্রয়ী যাতে মুখ্য ভূমিকা থাকে গ্রাহকের আর লেন-দেন পর্যায়ে প্রতিরোধের দায়িত্ব নিতে হয় ব্যাংকের যা সম্পূর্ন রূপে প্রায়ই অসম্ভব, কষ্টসাধ্য ও ব্যায় বহুল। বিভিন্ন গোষ্ঠীর জালিয়াতদের জন্য বিভিন্ন কৌশল প্রয়োজন। বন্ধু রূপী বা পরিবারের আভ্যন্তরীণ ও প্রলুব্ধ সুযোগ সন্ধানীদের কেবলমাত্র গ্রাহক পর্যায়ে সাধারণ সতর্কতার মাধ্যমেই প্রতিরোধ করা যায়, কারণ তারা তথ্য পায় খোদ গ্রাহকের নিকট হতে। আর আভ্যন্তরীণ জালিয়াতদের বা বেড়ায় ক্ষেত খাওয়া প্রতিরোধের জন্য দরকার চলমান ও বিবর্তনীল প্রতিরোধ ব্যাবস্থা। কিন্তু' দুর্দমনীয় হচ্ছে দুর্জন প্রযুক্তি বিদ্বান ও সংগঠিত জালিয়াত চক্র। তবে ব্যাংক-গ্রাহকের যৌথ ও সমন্বিত ভূমিকায় এই হুমকি সহজেই মোকাবেলা করা বা সহনীয় মাত্রায় কমিয়ে আনা সম্ভব, কারণ তথ্য চুরি ঠেকানো গেলে জালিয়াতির সুযোগও কমে আসবে ।
প্রথম ধাপে এই তথ্য সংগ্রহের জন্য জালিয়াতরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পন্থা উদ্ভাবন করেছে। এরা এতটাই সৃষ্টিশীল যে ব্যাংকগুলি যখন যে পন্থাই অবলম্বন করেছে তারা তা ভাঙ্গার পন্থাও বের করেছে। মূলত যারা সাইবার ক্রাইমের সাথে জড়িত তারা এই গ্রহের সবচেয়ে মেধাবীদের অন্যতম। যার ফলে সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে ব্যাংক গুলি এখন পর্যন্ত প্রায় পুরোটাই ব্যর্থ, কিছুটা সাফল্য আছে সংগঠিত অপরাধ উদঘাটনে। যদিও ব্যাংকগুলি তাদের নিরাপত্তা বাড়াতে সম্ভাব্য সব কৌশলই অবলম্বন করেছে কিন্তু প্রায় সকল ক্ষেত্রেই ঝুঁকি চিহ্নিত হয়েছে অপরাধীদের দ্বারা অপরাধ সংগঠনের পর। এর ফলে একই ধরনের অপরাধের হার কিছুটা কমলেও অপরাধের মাত্রা কখনোই কমেনি বরং দিনকে দিন তা আরও বহুমাত্রিক হয়েছে। অস্থির সময়ে দ্রুত পরিবর্তনশীল চাহিদার বাজারে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির অসমন্বিত বিকাশে প্রযুক্তি অবকাঠামোতে মানানসই কোন ”আদর্শ” গড়ে না ওঠায় এবং নানাবিধ প্রযুক্তির অপরিমেয় ও অপরিমিত ব্যাবহারিক প্রয়োগের সম্ভাব্যতার প্রেক্ষিতে নিরাপত্ত্বা বজায় রাখা আরও জটিল হয়ে উঠছে। আর মোবাইল প্রযুক্তির অভূত পূর্ব উৎকর্ষতায় হঠাৎ আগত এই পরিস্থি'তি ব্যাংকের চিরায়ত ভূমিকা, কর্তৃত্ব ও অবয়বকে যুগ সন্ধি ক্ষনে উপনীত করেছে। পাশাপাশি যে মুদ্রাকে কেন্দ্র করে ব্যাংকের জন্ম ও বিকাশ তার চরিত্র ও চেহারা আমূল পাল্টে গেছে। জন্ম লগ্নে আদিকালের মূল্যবান বস্তু' বা রত্ন-পাথর বা ধাতব মুদ্রার ব্যাবহারিক মূল্য ও মূল্যমান দুটোই থাকলেও কালক্রমে আধুনিক মুদ্রা ব্যবস্থায় কাল্পনিক মূল্য আরোপিত ব্যবহারিক মূল্যহীন কাগুজে (তা গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড বা ফিয়াট যাই হউক) মুদ্রার প্রচলন। অনলাইন ব্যাংকিং এর বিকাশ মুদ্রাকে কেবল মাত্র ইলেকট্রনিক কোডে নির্মিত বিমূর্ত ধারণায় পরিণত করেছে যা কারও ক্রয় ক্ষমতার সাথে সংশ্লিষ্ট ”সংখ্যা” মাত্র। বর্তমান ব্যাবস্থায় সারা জীবনে একটি মুদ্রাও স্পর্শ না করে মুদ্রার সমস্ত প্রয়োজন মিটানো বা মালিকানা বজায় রাখা সম্ভব!! তাই মুর্ত মুদ্রার ধারক হিসাবে যে ব্যাংক ব্যাবস্থার ক্রমবিকাশ বিমূর্ত মুদ্রার আগমনে আজকে আমরা ব্যাংক শাখা বলতে যা বুঝি ভবিষ্যতে তার অস্তিত্ব নাও থাকতে পারে, কিম্বা দেখা যেতে পারে সম্পূর্ন ভিন্ন চেহারায় ভিন্ন দক্ষতায় এবং ভিন্ন প্রয়োজনে। এই পরিবর্তন মুদ্রা ব্যাবস্থার পরিচালন অবকাঠামো হিসাবে ব্যাংক ব্যাবস্থার প্রয়োজন ও ভূমিকাকে নতুন ভাবে নিরূপণ করবে আগামীর অদৃশ্য মুদ্রা। ইতোমধ্যেই প্রায় সব ক্ষেত্রেই মুদ্রা তার ভৌগলিক সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করেছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার চেয়ে আধুনিক ব্যাংক ব্যাবস্থার নিরাপত্তা আরও বেশী জটিল ও কঠিন হয়ে উঠবে কারণ আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থায় ব্যাংকের কোন নিরাপত্তা সীমা থাকবে না। ব্যাংক স্থানীয় হলেও ঝুঁকি সব সময়ই আন্তর্জাতিক। তাই আমাদের অনলাইন ব্যাংকিং অবকাঠামো উন্নত বিশ্বের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও মোকাবেলা করতে হবে উন্নত বিশ্বের মত একই ঝুঁকি। এক সময় কেবল মাত্র গোপন পাসওয়ার্ড লেন দেনের সুরক্ষার জন্য যথেষ্ট হলেও বর্তমানে কেবল পাসওয়ার্ড নির্ভর সুরক্ষা দুর্বলতম সুরক্ষা যা যত ক্ষন আক্রান্ত না হয় তত ক্ষন সুরক্ষিত। কারণ পাসওয়ার্ড যত দুর্বোধ্য বা পেটা ডিজিটের হোক জালিয়াতরা তা চুরি করতে সক্ষম। কারণ রেলগাড়ির গতিতে ব্যাংক জালিয়াতি প্রতিরোধ সক্ষতা অর্জন করে আর জালিয়াতরা সুপারসনিক গতিতে তাদের কৌশল বদলায় কারণ সাইবার ক্রাইমে যারা জড়িত তারা এই গ্রহের অন্যতম সরা কিছু বুদ্ধিমান প্রাণী! বর্তমানে ব্যাংক যে কৌশলই অবলম্বন করুক তা দুদিন আগে পরে জালিয়াতরা তা ভাঙ্গতে সক্ষম। এখন তারা এতটাই দক্ষতা অর্জন করেছে যে কোন একক পদ্ধতিতে এর প্রতিকার সম্ভব নয়। তাই ব্যাংকগুলি মাল্টি চ্যানেল/লেয়ার পাসওয়ার্ড ও বায়োমেট্রিক আইডি অথেনটিকেশনসহ নানা উপায় নিয়ে নিরন্তর কাজ করে চলেছে।
এই বাস্তবতায় প্রযুক্তি একই সাথে ব্যাংকের সবচেয়ে বড় শক্তি এবং দুর্বলতা। আর আমাদের মত অ/অর্ধ শিক্ষিত বা সার্টিফিকেট নিরূপিত এবং পরিসংখ্যানে প্রমাণিত শিক্ষিত জাতির জন্য গোদের উপর বিষের ফোঁড়া প্রযুক্তি বিমুখ এবং অদক্ষ ব্যবহারকারী গ্রাহক। কারণ বর্তমান প্রযুক্তি নির্ভর ব্যাংক ব্যাবস্থায় এর নিরাপত্তা হুমকি যেমন বহুমুখী তেমনি এর প্রতিরোধেও দরকার বহুমুখী ও সমন্বিত উদ্যোগ। কেবল ব্যাংক বা সরকার কারও পক্ষেই একক ভাবে এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কোন ক্রমেই সম্ভব নয়, যদিনা এর ব্যবহারকারী গ্রাহক প্রযুক্তি নির্ভর ব্যাংকিং এর জন্য যথাযথ জ্ঞান, দক্ষতা, সক্ষমতা ও সচেতনতা বোধ অর্জন করে।

No comments:

Post a Comment