Saturday, May 30, 2015

ধর্মের অধর্ম ও অধর্মের ধর্ম!

দেখতে দেখতে ধর্মের বয়স তো কম হল না! অন্য সকল বিষয়ে মানুষে মানুষে মত পার্থক্য দিনে দিনে ক্রম হ্রাস মান হলেও একমাত্র ধর্মের ক্ষেত্রেই এর ব্যতিক্রম বরং তা অনেক ক্ষেত্রেই ক্রমবৃদ্ধি মান। এর একমাত্র কারণ অন্য সকল বিষয় নিয়ে মানুষে মানুষে আলোচনা হলেও ধর্ম নিয়ে কেবল কপট বা আসল ঝগড়া এবং জিহাদ বা ক্রুসেড ছাড়া কখনই প্রকৃত আলোচনা হয় না। যদি হত তাহলে এত দিনে মানুষের মধ্যে ধর্মীয় মতানৈক্য দূর হয়ে যেত অথবা একেবারেই সার্বজনীন সহনশীল পর্যায়ে থাকত যা কেবল বৈচিত্র্য আনত বিভাজন নয়।
পৃথিবীর সব ধর্ম ও বিজ্ঞান এক মাত্র যে বিষয়ে ঐকমত্য তা হল এই মহাবিশ্ব পরস্পর নির্ভরশীল একটা সুপার সিস্টেম যার অভ্যন্তরে রয়েছে অসংখ্য সিস্টেম ও সাব সিস্টেম যা একই সুপার সিস্টেমের অংশ। যে কোন সিস্টেমে কালের বিবর্তনে এর অন্তঃস্থিত অসামঞ্জস্য হ্রাস পায় অথবা বিবর্তিত হয়ে সামঞ্জস্য বিধান করে সিস্টেমের অস্তিত্ব বজায় রাখে যা এনট্রপি নামে পরিচিত, আর এটাই প্রকৃতির নিয়ম যদি না কোন শক্তি এর অন্যথা ঘটায়। পৃথিবীর প্রায় সব ধর্মই সিস্টেম থিওরিকে সমর্থন বা অ-প্রতিবাদ করলেও প্যারাডক্সিক্যালী এই বিধির একমাত্র ব্যতিক্রম আমাদের ধর্মীয় সিস্টেম নিজেই। বর্তমান পৃথিবীর অধিকাংশ সমস্যাই হয় ধর্ম থেকে অথবা ধর্মের জন্যে সৃষ্ট। এই সমস্যার একমাত্র কারণ আলোচনা না হওয়া এবং এর সমাধানও একমাত্র আলোচনাতেই নিহিত আছে। এ আলোচনা শেষ হতে কয়েক বছর থেকে দশক বা শতক এমনকি হাজার বছরও লাগতে পারে তবে অবশ্যই তা একদিন ধর্মীয় এন্ট্রপি বিধান করবে ভিন্নতা সত্ত্বেও। দুর্ভাগ্য জনক ভাবে সে আলোচনা এখনও শুরুই হয়নি!
আমাদের নাগরিক সমাজের বড় একটা অংশ নিজেদের শান্তি প্রিয় মনে করেন। শুধু মনেই করেন না শান্তির স্বার্থে তারা অনেক কিছু ত্যাগও করেন। তবে বেশীর ভাগ সুশীল নাগরিক সাধারণ যে ত্যাগটি করেন তা হল ধর্ম নিয়ে পাবলিকলি আলোচনা একেবারেই পরিত্যাগ! এমনকি অনানুষ্ঠানিক বা সামাজিক আড্ডা আলোচনাতেও সচেতন উদাসীনতায় এড়িয়ে যায়। আর যারা আলোচনাতে অংশ নেয়, গুন বিচারে তারা আসলে ঝগড়া ঝগড়া খেলে। প্রত্যেকেই অকাট্য যুক্তিতে নিজ মতের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরলেও আসলে কোন আলোচনা হয় না কারণ অন্যের যুক্তি কেউ শোনেই না, বিবেচনা করা তো দূরে থাক। আর যে আলোচনায় কোন বিবেচনা করার বিষয় নাই তা অবশ্যই ঝগড়া অথবা পাগলের প্রলাপ!
ধর্মের সাধারণ মানে যদি জীবনাচরণ হয় তাহলে পৃথিবীতে তিন ধরনের মানুষ আছে। প্রথমত ধার্মিক যারা মূলত দুই প্রকার, যথা আসমানে সৃষ্ট ধর্মানুসারী যেমন মুসলমান, খৃষ্টান ইত্যাদি এবং জমিনে সৃষ্ট ধর্মানুসারী যেমন হিন্দু, বৌদ্ধ ইত্যাদি। দ্বিতীয় শ্রেনী হল অধার্মিক বা নাস্তিক যাদের ঘোষিত ধর্ম বিজ্ঞান হলেও পালিত ধর্ম নিজের বিশ্বাস ও পছন্দের মতবাদ তাড়িত। আর অন্য টি হল ধর্মাভিনেতা বা বকধার্মিক যারা ধর্ম জানলেও ততখানিই মানে যতখানি ধার্মিক সাজতে দরকার, আর বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের ধর্ম পালনের কারণ যতটা না ধর্মীয় তার চেয়ে বেশী জাগতিক সুবিধা। এরা গিরগিটি শ্রেনীভুক্ত হওয়ায় ধার্মিক বা নাস্তিক যে কোন খোলসেই থাকতে পারে বকধার্মিক এবং এরাই সংখ্যা গরিষ্ঠ!
ধার্মিক ও নাস্তিক উভয়ের একটাই অন্বেষণ আর তা হল "সত্য-সুন্দর-ভাল"। সে জন্য ধার্মিকেরা নির্দিষ্ট পূর্বসূরিদের পথ ও মতকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞানে তা অনুসরণ করে স্থীর বিশ্বাসে ও বিনা প্রশ্নে। আর নাস্তিকেরা "সত্য-সুন্দর-ভাল" খোঁজে নিজ দায়িত্বে ও নিজের পছন্দের মানুষ ও মতবাদের কাছে যা আখেরে মূলত বিশ্বাস নির্ভর! তাছাড়া অধার্মিক আস্তিক ও ধার্মিক নাস্তিক নামক অপভ্রংশ আছে যারা আসলে সিংহ ভাগ ধর্মীয় ফ্যাসাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কারণ।
আমাদের বর্তমান বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও দুই লাখ বছরের বেশী সময়ের অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা দিয়ে এ মতানৈক্য দূর করা বা সহনশীল মত পার্থক্যে আসা সম্ভব। যদিও এখন পর্যন্ত আস্তিক বা নাস্তিক উভয়েই আসলে বিশ্বাসী! কারণ এদের কারও কাছেই নিজের মতের স্বপক্ষে কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নাই! একদল বিশ্বাস করে 'ঈশ্বর আছেআর অন্যদল বিশ্বাস করে 'ঈশ্বর নাই'! যদিও উভয় পক্ষের কাছেই কিছু আপাত অকাট্য যুক্তি আছে। কিন্তু যুক্তি আর প্রমাণ এক জিনিস নয়! দৃশ্যত অযৌক্তিক মনে হলেও সাম্প্রতিক কালে অত্যাশ্চর্য ভাবে বেশীর ভাগ আস্তিক ও নাস্তিক উভয়ের কাছেই বিগ ব্যাং থিওরিই তার মতের পক্ষে সবচেয়ে জোরালো যুক্তি! বিশেষ করে কিছু জনপ্রিয় তোতা পাখিরা বিগ ব্যাং এর সত্যতা সম্পর্কে অসংখ্য ঐশী প্রমাণ হাজির করেছেন যা বিগ ব্যাং আবিষ্কারের বহু আগে থেকেই কিতাবে ছিল কিন্তু অজ্ঞাত কারণে বিগ ব্যাং আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত তাঁরা সেটা খুঁজে পাননি! যদিও বিগ ব্যাং এখন পর্যন্ত বেশ কিছু 'যদি', 'কিন্তু', 'তবেজাতীয় চলক এর উপর প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক মতবাদ মাত্রপর্যবেক্ষণে প্রমাণিত কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নয়। এই চলক গুলির যে কোন টির সামান্য হেরফেরে সব কিছু বেমালুম বদলে যেতে পারে। তাত্ত্বিক পদার্থ বিদ্যার অনেক মৌলিক ধারণাই গত একশ বছরে বদলে গেছে। সে জন্য বিগ ব্যাং মূলত এম থিওরি (কোন নির্দিষ্ট তত্ত্বের বদলে একগুচ্ছ তত্ত্বের যখন যেখানে যেটা লেগে যায়!) নির্ভর হওয়ায় তত্ত্ব হিসাবে বিগ ব্যাং এখনও মোটেই বিগ নয় একেবারে আঁতুড় ঘড়েই আছে, আগামীতে আরও পরিপক্ব হবে আর সেই সাথে বিবর্তিত হয়ে নবতর রূপে আবর্তিত হবে! কিন্তু সবচেয়ে বড় হতাশার বিষয় বিগ ব্যাং যত বড়ই হোক না কেন তা কখনই ঈশ্বর প্রশ্নের মীমাংসা করতে পারবে না কারণ বিগ ব্যাং এর মৌল স্বীকার্য হল জাগতিক স্থান-কাল বিগ ব্যাং এর ফল যা আবশ্যিক ভাবে এর পরে সৃষ্ট এবং বিগ ব্যাং এর আগের কোন ঘটনাই এই তত্ত্বে ব্যাখ্যা সম্ভব নয় যা ছাড়া ঈশ্বর প্রশ্নের বৈজ্ঞানিক উত্তর পাওয়া সম্ভব নয়। আবার স্থান-কালে অবস্থান করে কোন মতেই তার বাইরের ঘটনা বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের আওতায় আনা সম্ভব নয়! ফলে বিগ ব্যাং তত্ত্ব শত ভাগ সঠিক হলেও তার মাধ্যমে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ বা অপ্রমাণ কোনটাই সম্ভব নয়, তাই বিগ ব্যাং এর কাছেও ঈশ্বর প্রশ্নে বিশ্বাসই শেষ আশ্রয়!
জগতের অন্য সব ধর্মের সাথে ইসলাম এর মৌলিক পার্থক্য হল এটা রাষ্ট্রের জন্য আবশ্যিক এবং এর নাগরিকদের জন্য ঐচ্ছিক পালনীয় ধর্ম। অর্থাৎ অন্য সব ধর্ম যে কোন দেশে পালন করা গেলেও সাচ্চা মুসলমান হতে গেলে শুধু নিজে বা পরিবার বা সমাজ নিয়ে ধর্ম পালন করলেই হবে নাজান-মাল-ঈমান-আকিদা সব কিছু দিয়ে রাষ্ট্রকেও ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার জিহাদই জীবনের প্রধান লক্ষ্য হতে হবে। তবে ইসলামী রাষ্ট্রের সব নাগরিকদের ইসলাম পালন বা মুসলমান হওয়া আবশ্যিক না হলেও অন্য সব ধর্মের লোক জনকে বুঝিয়ে বা সম্পদের বিনিময়ে ধর্মান্তরিত করাটা প্রতিটি মুসলমানের জন্য আবশ্যিক ঈমানী দায়িত্ব ও পারলৌকিক সমৃদ্ধির সোপানই নয় নরক মুক্তির সহজ সস্তা কিন্তু অব্যর্থ উপায়। কাউকে জোর করে ধর্মান্তরিত করা না হলেও কেউ মুসলমান না হলে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় তাদের কোন রাজনৈতিক অধিকার থাকবে না, কিন্তু পূর্ণ স্বাধীনতা ও অধিকার থাকবে ইসলামের অন্তরায় সৃষ্টি না করে নিজ নিজ ধর্ম পালনের, সবাই ইসলামের 'হেফাজতে' স্ব স্ব ধর্ম পালন করবে! ইসলামের অন্যতম মূল বৈশিষ্ট্য হল কেন্দ্রীভবন অর্থাৎ ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত কাঠামো বদ্ধ ক্রম পূঞ্জী ভবন। পাড়ার জামাতে ওয়াক্তিয়া, গ্রামের জামাতে জুম্মা এবং অঞ্চলের জামাতে ঈদ এবং বিশ্ব জামাতে হজ্জ্ব এই ধারাবাহিকতারই অংশ। যেহেতু ইসলামের পূর্ণতা রাষ্ট্র কাঠামো নির্ভর আর এজন্যই কাঠামো বদ্ধ ক্রম পূঞ্জী ভবনের ব্যবস্থা। ব্যক্তি মুসলমানেরা নিরাপদ হলেও সংগঠিত মুসলমানেরাই যত আতংকের কারণ তা জাতীয় বা আন্তর্জাতিক সকল ক্ষমতা জীবিদের জন্যই। ইসলাম একই সাথে ব্যক্তির জন্য জীবনাচার ও সমষ্টির জন্য রাষ্ট্রাচার। এই দ্বৈততাই এর সবলতা এবং দুর্বলতম দিক। তবে জীবনাচার হিসাবে ধর্ম ইসলাম কেবল মুসলমানের জন্য পালনীয় হলেও রাষ্ট্রাচার হিসেবে ইসলাম সকল নাগরিকের জন্য পালিতব্য। ইসলামের উত্থান এজন্যই আর সকলে গাত্রদাহের গুপ্ত কারণ। আর এই খানেই জঙ্গিবাদ বা মৌলবাদ দমনের নামে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণার মূল কারণ নিহিত।
এটা ঐতিহাসিক প্রামান্য সত্য যে ইসলামের পরে এখন পর্যন্ত অন্য কিছুই এর মত বা বেশী প্রভাব আমাদের বিনির্মিত সমাজ ও যাপিত জীবনে ফেলতে পারেনি বরং এর বিপরীতে হাজারও তন্ত্রে-মন্ত্রে সমাধান খোঁজার চেষ্টা হয়েছে এবং হচ্ছে ফলে বর্তমান পৃথিবীতে তন্ত্রের কোন অভাব নাই কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন তন্ত্রই এর ক্লাসিক রূপে কোথাও প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি, যে টুকু হয়েছিল তাও বিশুদ্ধ থাকেনি, সবই সচেতন ককটেল অথবা নিরুপায় ভেজাল তন্ত্র হিসেবে বিকশিত কিন্তু খাঁটি তন্ত্রের মুখোশে প্রকাশিত হয়েছে! সমাজতন্ত্রে ধোঁয়া হলেও কখনই আলোকিত করে আগুন জ্বলে উঠতে পারেনি এতে আগুন জ্বলার সমস্ত শর্ত বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও কারণ পৃথিবীর সিংহ ভাগ মানুষ কোন না কোন ধর্মের অনুসারী আর সব ধর্মেই ধর্ম রক্ষা বড়ই ধর্মের কাজ এবং ধর্মহীনতার কাজে সহযোগীতা কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজমের জগাখিচুরী, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তত্ত্বের ইলিউশন সাধারনের বোধগম্য করতে না পারায় তাদের কাছে বাম, সমাজতন্ত্রী, কমিউনিস্ট সবটাই একটা ডিলিউশন যে তারা 'নাস্তিক' যা সকল ধর্মের মৌল স্বীকার্য ঈশ্বর বিশ্বাসের সাথে তিব্র সাংঘর্ষিক। অথচ কমিউনিজম ধর্মহীন হলেও সমাজতন্ত্র ধর্ম নিরপেক্ষ মতবাদ কিন্তু তা কোন ক্রমেই ধর্ম বিরোধী কিম্বা ধর্মহীনও নয়! কেবল মাত্র মানুষের নরক ভীতি আর স্বর্গ প্রীতিই সমাজতন্ত্রের অপমৃত্যুর কারণ। 
  আসলে গুন বিচারে ইসলাম যত খানি ধর্ম তত্ত্ব তার চেয়ে অনেক বেশী রাজনৈতিক তত্ত্ব এবং আমার বিবেচনায় তা বর্তমানে বাজারে আলোচিত, প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত অন্য যে কোন রাজনৈতিক তত্ত্বের চেয়ে উন্নততর। ইসলাম কি কারণে রাজনৈতিক মতাদর্শের বদলে ধর্ম নামে বাজারে এলো তা আমার কাছে একটা দুর্বোধ্য রহস্য! তবে ইসলাম যদি রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে বাজারে আসত তাহলে এর বিস্তার অর্ধ জাহান পর্যন্ত এসে আবার রিভার্স মোডে যেত না বরং এরপর তামাম জাহান স্বেচ্ছায় ইসলামী রাজনীতির ছায়াতলে আসত এর বস্তুগত উপযোগিতার কারণেই! সে জন্য ইসলামী ব্যবস্থা কায়েমের কারণ হিসাবে ধর্মে আল্লাহ-নবীর হুকুম আছে কিনা সে আলোচনায় না গিয়েও কেবল মাত্র প্রয়োজন, উপযোগিতা এবং উপযুক্ততার কারণেই রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসাবে ইসলামের ব্যবস্থা (কিন্তু ইসলামী ব্যবস্থা নয়) সমাজ-রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হত।