বাংলাদেশের এসএমই খাত ঐতিহ্যগত ভাবেই মূলত অপেশাদারী ও অসংগঠিত এবং লগ্নীকৃত শ্রম-সম্পদের তুলনায় বাণিজ্যিক ভাবে অপেক্ষাকৃত কম উৎপাদনশীল ও কম ঝুঁকিসহ! বিগত দুই দশকে মাইক্রোক্রেডিট হিসাবে বাজারে যে বিশাল অর্থ সরবরাহ ঘটেছে তার একটা বড় অংশ 'ছোট' ব্যবসা তৈরীর চেষ্টায় ব্যায় হয়েছে। বিশেষ করে গত দশকে মাইক্রোক্রেডিটের লক্ষ্যণীয় সাফল্য হল বাংলার আনাচে কানাচে ব্যাঙ এর ছাতার মত হঠাৎ গজিয়ে ওঠা অসংখ্য ছোট ছোট দোকান। দৃশ্যত এটা ইতিবাচক হলেও আখেরে তা কোন মতে টিকে থাকা মাইক্রোএন্টারপ্রাইজ খাতের জন্য বুমেরাং হয়ে যায়। অনভীজ্ঞ নব্য প্রতিদ্বন্দীদের অবিবেচিত প্রতিযোগীতা ক্রমান্বয়ে তাদের নিজেদের ও অন্যদের অনেক ব্যবসাই লাটে তুলে। অধিকাংশ নব্য দোকান প্রথম বছর পার হবার আগেই বন্ধ বা মালিক/ব্যাবসা বদল হয়। মাইক্রোক্রেডিটের এই আপাত উন্নয়ন এডভেঞ্চারের ফলাফল হিসাবে বিশাল পুঁজির অপচয় হয় বা আটকে যায় বা নষ্ট হয়ে যায় যা সামগ্রীক এসএমই খাতের বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। কেবল পুঁজি সরবরাহ যে টেকসই উন্নয়ন আনতে পারে না মাইক্রোক্রেডিটের অপ্রত্যাশিত ব্যার্থতাই তার বড় প্রমাণ।"
এসএমই খাত এর উন্নয়ন নিয়ে হইচই নতুন নয় তবে হাল আমলে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা-এন্টারপ্রেনরশীপ। ”দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে এসএমই খাতের উন্নয়নের বিকল্প নেই”- এ ব্যাপারে সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যবসায়ী সমাজ, অর্থনীতিবিদ, দাতাগোষ্ঠী সবাই একাট্টা। বিশেষ করে মাইক্রোক্রেডিটের সুনামে ভাটা পরায় এর কদর এখন উর্ধমূখী। বাংলাদেশ সরকার এসএমই ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে প্রতি বছর বাজেট দিয়ে আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এসএমই নীতিমালা করে ব্যাংকারদের জন্য গাইডলাইনও তৈরি করেছে। প্রতি বছর এ খাতে হাজার কোটি টাকা ঋণ বরাদ্দের টার্গেট দেয়া হচ্চে। দাতা-বন্ধু-পরামর্শক সবাই নানা দাওয়াই নিয়ে আসছে এ খাতের উন্নয়নে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ইত্যাদি নানা সুন্দর সুন্দর কথা বলা হচ্ছে। এক সময় মাইক্রোক্রেডিট নিয়ে এরকম শোনা যেত, বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়ন ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য তা যুগান্তকারী সমাধান হিসাবে মনে করা হতো। এখন মাইক্রোক্রেডিটের সাফল্য শুধু প্রশ্নবিদ্ধই নয়, অধ্যাপক আনু মুহম্মদ এর মতে,“বৃহৎ বাণিজ্যের একটি সফল মাধ্যম হিসেবে ক্ষুদ্রঋণ মডেল অবশ্যই স্বীকৃতি পেতে পারে। কিন্তু দারিদ্র্য বিমোচন কিংবা নারীর ক্ষমতায়নে এর সাফল্যের দাবি ভ্রান্ত ও প্রতারণামূলক”। মাইক্রোক্রেডিট কেবল ঋণের বাজারই সৃষ্টি করেনি, এর গ্রহীতাদের পরিণত করেছে ‘বন্ডেড লেবার’ এ। কার্যত: মাইক্রোক্রেডিট স্বল্প সময়ে অধিক মুনাফা সৃষ্টির সস্তা ও খুবই কার্যকর একটি হাতিয়ার।
বর্তমানে মাইক্রোক্রেডিটের “বৃহৎ বাণিজ্যের” এই বাজার নানা কারণে সংকুচিত হয়ে আসছে। পুঁজির চিরন্তন স্বভাব অনুযায়ী তা এখন নতুন বাজার খুঁজবে এটাই স্বাভাবিক। স্বভাব গুণে বা দোষে যাই হোক, পুঁজির স্বভাব হল ছড়িয়ে পড়া, মুনাফা হয়ে আত্ম-স্ফীতি ঘটানো। এজন্য বাজার অন্ত-হীনভাবে বেড়ে চলতে হবে মুনাফায় আত্ম-স্ফীত পুঁজিকে পুনঃ পু্নঃ বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টির জন্য। বর্তমান সাম্রাজ্যবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেণীকে শোষণের মাধ্যমে উদ্বৃত্ত মূল্যের উৎপাদন হয়। আর এই উদ্বৃত্ত উৎপাদন ভোগ করে পুঁজিপতিরা। আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নীকারী প্রতিষ্ঠানসহ তথাকথিত দাতারা পুঁজি’র জন্য লাভজনক বাজার ও নিরাপদ অবকাঠামো তৈরি করে থাকে। যেমনটি মাইক্রোক্রেডিটের ক্ষেত্রেও করেছে। পুঁজির নতুন বাজার হিসাবে এখন তাদের চোখ পরেছে এসএমই এর দিকে। এ বাজার মাইক্রোক্রেডিটের চেয়ে অনেক বড়, বিস্তৃত ও সম্ভাবনাময়। “বৃহৎ বাণিজ্যের” এক বাজার শেষ না হতেই আরেক দিকে বাম্পার বাণিজ্যের মহাবাজার এর হাতছানি। পুঁজির জন্য এর চেয়ে বড় সুখবর আর কি হতে পারে! বস্তুত: এসএমই উন্নয়নের নামে বর্তমানে যা কিছু হচ্ছে তার আসল লক্ষ্য পুঁজি লগ্নির নতুন অবকাঠামো তৈরি ও ঋণের বাজার সৃষ্টি। আর এজন্যই দাতা-সরকার সকলেই এসএমই খাতের উন্নয়ন মাপছে এই খাতে ঋণ প্রবাহের পরিমাণ দিয়ে। আসলে দাতাদের তথাকথিত উন্নয়ন কেবল বাণিজ্য’র সহায়ক শক্তিই নয়, উন্নয়ন নিজেও এখন বাণিজ্য হিসাবে সফল ও লাভজনক, আর তা সর্বজন বিদিত। স্থানীয়, জাতীয়, আন্তর্জাতিক সকল ক্ষেত্রে একই চিত্র দৃশ্যমান।
দাতাগোষ্ঠী থেকে শুরু করে সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক, মহাজন ব্যাংক, নানা নামের নানা ঢং এর আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ সবারই নজর এখন এসএমই এর দিকে। কিন্তু সব এসএমই এর দিকে নয়, শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠিত ও লাভজনকভাবে পরিচালিত এসএমই এর দিকে। যারা অনেক বন্ধুর পথ পারি দিয়ে এখন একটা সুবিধাজনক অবস্থায় এসেছে তাদের লাভে ভাগ বসানোর জন্যই এতো আয়োজন। বাংলাদেশের এসএমই খাতের উন্নয়নের জন্য দাতা ও বন্ধুরা মিলিয়ন ডলারের প্রকল্প হাতে নিয়েছে যেমন, এডিবি ১২৬.৬৭ মিলিয়ন ডলার, প্রকল্প নং-৩৬২০০, আগস্ট ২০০৯। প্রকল্পের মেয়াদ অক্টোবর ২০০৯ হতে সেপ্টেম্বর ২০১২ । এই প্রকল্পে এডিবি ৭৬ মিলিয়ন ডলার দেবে ৮ বছরের গ্রেস পিরিয়ড সহ ৪০ বছরে পরিশোধযোগ্য ঋণ হিসাবে। যার সূদের হার গ্রেস পিরিয়ডে ১% এবং অবশিষ্ট সময়ের জন্য ১.৫% । স্বল্প সুদের কারণে দৃশ্যত এটি একটি মহৎ উদ্যোগ মনে হলেও এর আসল মোজেজা অন্য জায়গায়। কারণ এই ঋণ ডলারে পরিশোধ করতে হবে। আর অতীত অভীজ্ঞতানুযায়ী টাকার অবমূল্যায়নের ধারাবাহিকতায় আগামী ৪০ বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান বর্তমানের অর্ধেকেরও নীচে নেমে আসবে। বর্তমান বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার কারণেই তা অনিবার্য। ফলে গৃহীত অর্থের বহুগুণ বেশী পরিশোধ করতে হবে ভবিষ্যতে। শুধু কি তাই! এই ঋণের সাথে বিনামূল্যে আরও আছে হাজারো শর্তের বেড়াজাল। এই ঋণ বা বিনিয়োগের আসল লক্ষ্য মুনাফা কামানো নয়, শর্ত দেবার ক্ষমতা অর্জন। পুঁজি’র সুবিধা মত সবকিছু সংস্কার, বদল করার শর্ত। সবধরনের পুঁজি যাতে নির্বিঘ্নে কারবার করতে পারে তার ব্যবস্থা করার ক্ষমতা অর্জন।বিশ্বব্যাংকের সূত্রে এডিবি’র হিসাব মতে ২০০৬ সালে দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারী এন্টার প্রাইজ এর সংখ্যা ছিল মোট ৬.৮ মিলিয়ন (সে হিসাবে ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০মিলিয়নের উপরে এবং লাভজনক ও নিশ্চিত বিনিয়োগের সুযোগও আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে), তাদের মধ্যে কমপক্ষে ১ মিলিয়ন সফল উদ্যোক্তা আছে যাদের কাছে নিশ্চিন্তে ৩৯৫.৯৭ বিলিয়ন টাকা বিনিয়োগ করা যায়! নতুন এসএমই প্রতিষ্ঠা বা কোন রকমে টিকে থাকাদের উন্নয়নের কোন ব্যবস্থা এই প্রকল্পে নেই। কারণ প্রকল্পটির উদ্দেশ্যই ঋণের এই বিস্তৃত নতুন বাজারে পুঁজি’র মুনাফা নিশ্চিত করা, এসএমই খাতের উন্নয়ন নয়। সব ধরণের পুঁজি যাতে নিরাপদে স্ব স্ব কারবার করতে পারে তার পরিবেশ তৈরি করাই দাতাগোষ্ঠীর কাজ। সেই পুঁজির বিকাশ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকার প্রচ্ছন্নভাবে সহায়কের ভূমিকা পালন করছে । বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই ঋণ নীতিমালা অনুযায়ী যেসব উদ্যোক্তাদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা ও সামর্থ্য আছে কেবল তারাই এই ঋণ পাওয়ার যোগ্য। তেলীর মাথায় তেল নয়, এ যেন পুঁটিমাছ দিয়ে বোয়াল ধরা আর কি! বিশ্বপুজির নিয়ন্ত্রকেরা হয়ত গোটাকয়েক নোবেল প্রাইজও খরচ করবে এই ঋণের বাজার সৃষ্টি ও বৃদ্ধিতে অসামান্য অবদান রাখার জন্য! কারণ মাইক্রোক্রেডিটের চেয়ে এই বাজার বহুগুণ বড় এবং তা উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকবে। আমাদের মধ্য বিত্ত সমাজের যে অংশ এতদিন ঋণের জালের বাইরে ছিল এবার তাদের শিকার করার জন্যই এসএমই নামক এই পুঁটিমাছের বিকাশ ঘটাতে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ তথাকথিত সকল দাতা গোষ্ঠীদের এতো এন্তেজাম। এ বিষয়ে পুঁজিবাদের সুবিধাভোগী সকল পক্ষই দেশ-কাল-পাত্র নিরপেক্ষভাবে একাট্টা । আর আমরাও তাদের স্থানীয় এজেন্ট তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ, উন্নয়নবিদ, অর্থনীতিবিদদের কথামালার গোলক ধাঁধায় পরে উন্নয়ন নামক অদৃশ্য মূলা’র পিছে ছুটছি রাঘব বোয়ালদের খোরাক হতে।
বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থায় আমরা চাইলেই এই জাল থেকে বেড়িয়ে আসতে পারবনা। তারপরও আমাদের জাতীয় নীতিমালা ও নানা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জনগণের স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু এক্ষেত্রে সরকার দায়িত্বপালনে শুধু ব্যর্থই নয় বরং উল্টো ভূমিকা পালন করছে জনস্বার্থের বিপক্ষে, পুঁজির পক্ষে। এখনই সময় সঠিক সিদ্ধান্ত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের। দাতাদের প্রেসক্রিপশন মোতাবেক এসএমই এর উন্নয়ন নয়, আমাদের প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রয়োজনে আমাদের মত করেই এন্টারপ্রেনর (সুউদ্যোক্তা) সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সত্যই এসএমই এর বিকল্প নেই, কিন্তু সেজন্য এন্টারপ্রাইজের উন্নয়নের মাধ্যমে নয় (সেটা সম্ভবও নয়), গুরুত্ব দেয়া দরকার এন্টারপ্রেনর সৃষ্টি ও উন্নয়নের দিকে। তাহলে এন্টারপ্রেনরই এন্টারপ্রাইজ তৈরি করবে, সেটা ছোট, বড় না মাঝারী তা সময়ই ঠিক করে দেবে। সত্যিকার অর্থে এসএমই খাতের যে উন্নয়ন দেশের জন্য ভবিষ্যতে মঙ্গল বয়ে আনবে তা কেবলমাত্র এন্টারপ্রেনর সৃষ্টি ও তাদের উন্নয়নের মাধ্যমেই সম্ভব। নইলে আমরা পুঁজির শৃঙ্খলে নানা প্রকল্পের অবজেক্ট/বেনিফিসিয়ারী বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য গিনিপিগ হয়েই থাকব। স্বচেষ্টায় এবং কঠোর পরিশ্রমে নানা প্রতিকূলতা পারি দিয়ে যারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ও হচ্ছে তাদের নিয়ে বাণিজ্য হবে আর হাজারও সম্ভাবনা নীরবে ঝরে যাবে নিত্যদিন। তাই আমাদের সকল নীতিমালা ও কর্মসূচী কেবল কাগজে-কলমে এন্টারপ্রেনর বান্ধব করলেই হবেনা; দীর্ঘ মেয়াদী ও সামগ্রিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এদেশকে করতে হবে এন্টারপ্রেনর সৃষ্টির উর্বর ভূমি। কেবল নামমাত্র কিছু প্রকল্পের মাধ্যমে জনগণের অর্থের শ্রাদ্ধ নয়। সু-পরিকল্পিতভাবে এন্টারপ্রেনর তৈরির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। তবেই আমাদের এই বিশাল জনগোষ্ঠী অন্যের মুনাফা অর্জনের হাতিয়ার না হয়ে আত্মনির্ভরশীল জন সম্পদে পরিণত হবে। এদেশের মানুষ যে উৎপাদনশীল ও নূন্যতম সম্পদেই তারা জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে পারে তার বহু নজির আমাদের চারপাশেই বিদ্যমান। তাই, এসএমইকে শোষণের হাতিয়ার হিসাবে সৃষ্টি ও ব্যবহার না করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্র হিসাবে বিকশিত করার জন্য কার্যকর ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের এখনই সময়।